জেলা প্রতিনিধি, বাগেরহাট: বাগেরহাটের শরণখোলার মৎস্য আড়ৎ ও জেলেপল্লীতে চলছে হাহাকার। গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে গভীর সমুদ্রে ইলিশ আহরণকারী ট্রলার মালিক ও মহাজনরা।
গত তিন থেকে চার বছরে প্রায় অর্ধশত ট্রলার মালিক ও ব্যবসায়ী ঋণের চাপ ও লোকসানে পড়ে দেউলিয়া হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে নতুন করে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ইলিশ খাতে।
কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন জাল, ট্রলার ও শেষ সম্বল বসতভিটাও। অভাবে পড়ে কারো লাখ লাখ টাকা মূল্যের জাল, ট্রলার ঘাটেই নষ্ট হয়ে গেছে। ঋণের চাপ সইতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। আবার টাকার অভাবে বহু মালিক তাদের ট্রলার এ বছর সাগরে পাঠাতে পারেননি। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে শরণখোলার সমুদ্রগামী ট্রলার মালিক-মহাজনদের এমন দুর্বিষহ চিত্র।
কথা হয় মৎস্যজীবি সংগঠনের নেতা ও ইলিশের ব্যবসা থেকে হারিয়ে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। এদের মধ্যে উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী আলামিন ঘরামী। ১০-১২ বছর ধরে নিজের ট্রলারে সাগরে ইলিশ আহরণ করে আসছিলেন তিনি। প্রথম দিকে ভালো মাছ পাওয়ায় ব্যবসাও হয় রমরমা। কিন্তু গত তিন-চার বছর ধরে মৌসুমের শুরু থেকেই কয়েক দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, করোনা প্রভাব আর মৌসুমের অর্ধেক সময় নিষেধাজ্ঞা চলায় ব্যবসায় ধস নামতে থাকে। একপর্যায়ে মহাজন ও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার ও সুদে ঋণগ্রস্ত হয়ে যান প্রায় ৪০ লাখ টাকা। শেষমেশ কোনো উপায় না পেয়ে অল্পদামে জাল-ট্রলার বিক্রি করে কিছু দেনা শোধ করেন। কিন্তু বড় অংকের পাওনাদারদের চাপে গত দুই মাস আগে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি।
খোন্তাকাটা ইউনিয়নের মধ্য খোন্তাকাটা গ্রামের এক সময়ের প্রভাবশালী মৎস্য ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক মোল্লা জানান, কয়েক বছর ধরে ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় প্রায় ৬০ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩০ লাখ টাকায় তার বসতবাড়ি বিক্রি করে ইসলামী ব্যাংকের ১৮ লাখ টাকা ঋণ শোধ করেছেন। এখনো প্রায় ৪০ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। তার এফবি হাসিনা-সামাদ নামের ফিশিং ট্রলারটি এখন ঘাটে পড়ে আছে। অর্থের অভাবে এ বছর সাগরে যেতে পারেননি তিনি।
রায়েন্দা বলেশ্বর নদের পারের বাসিন্দা কামাল হাওলাদার জানান, পুঁজি সংকটে সাগরে যেতে না পারায় তার ৩০ লাখ টাকা দামের ট্রলারটি ঘাটেই শেষ হয়ে গেছে।
একই এলাকার রসু ঘরামী জানান, গত বছর বন্যায় তার ট্রলারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে প্রায় ১২ লাখ টাকার ক্ষতি হয় তার। ট্রলার না থাকায় ইলিশের ব্যবসাও বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কদমতলা গ্রামের আমিনুর হাওলাদার ৩০ লাখ টাকা এবং ইউনুচ হাওলাদার ১৫ লাখ ঋণ বোঝা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
রাজেশ্বর গ্রামের রফিকুল মিয়া দেনার চাপে তার ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ট্রলারটি বিক্রি করেছেন মাত্র ৪ লাখ টাকায়। এ ছাড়া সোবাহন মৃধা, রহমান মৃধা, আবু মৃধা, কামাল মৃধা টাকার অভাবে এখনো ট্রলার খুলতে পারেননি।
শরণখোলার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়ৎদার মো. কবির হাওলাদার জানান, ছয়টি ট্রলারের মধ্যে এ বছর মাত্র দুটি ট্রলার সাগরে পাঠিয়েছেন। টাকার অভাবে অন্যগুলো পাঠাতে পারেননি। একেকটি ট্রলার সাগরে পাঠাতে তিন-চার লাখ টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়েছে। কিন্তু তিন ট্রিপে দুই ট্রলারে মাছ বিক্রি করে তেলের দামও ওঠেনি। এভাবে প্রত্যেক ট্রলার মালিক ও মহাজন লোকসানে রয়েছেন।
মৎস্য ব্যবসায়ী মুজিবর তালুকদার জানান, গত বছর তার ট্রলাটি ঝড়ের কবলে পড়ে ১৬ জন জেলেসহ সাগরে ডুবে যায়। সাগরে ভাসমান জেলেদের অন্য ট্রলারের জেলেরা উদ্ধার করলেও তার প্রায় ৫০ লাখ টাকা দামের বিশাল ফিশিং ট্রলারটি আর পাওয়া যায়নি। ওই ট্রলারে ১০ লাখ টাকার জাল, জ্বালানি তেলসহ আরো প্রায় ২০ লাখ টাকা মালামাল ছিল। সব মিলিয়ে তার ৭০-৮০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি। কিন্তু সরকার থেকে কোনো সাহাযোগিতা পাননি বলে দাবি করেন মুজিবর।
উপজেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল হোসেন জানান, গত তিন-চার বছর ধরে একের পর এক লোকসান গুণছেন ট্রলার মালিক ও ইলিশের ব্যবসায়ীরা। তিনি এ বছর আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ, ব্র্যাক থেকে দুই লাখ এবং মহাজনের আড়ৎ থেকে ১৫ লাখসহ মোট ৩২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। কিন্তু সাগরে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশ পড়ছে না। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হওয়ায় কোনো ব্যবসায়ীই এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখতে পারেনি।
বাংলাদেশ ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও শরণখোলার বিশিষ্ট মৎস্য ব্যবসায়ী এম সাইফুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘গত বছর আমার প্রায় কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এবার ধার-দেনা করে দুটি ট্রলার সাগরে পাঠিয়ে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাইনি। তাছাড়া জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপে পড়েছে ব্যবসায়ীদের। দফায় দফায় প্রাকৃতিক দর্যোগ, মৌসুমের প্রায় তিন মাস নিষেধাজ্ঞা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ না পাওয়ায় আমার মতো সবাই কমবেশি দেনাগ্রস্ত হয়েছেন। ’
শরণখোলা উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় বলেন, ‘ইলিশ উন্নয়ন ফান্ড’নামে একটি তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া সরকারের মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে। এটি পাস হলে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ট্রলার মালিক ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া, মৎস্য আহরণকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনো নিবন্ধিত জেলে মারা গেলে তার পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা এবং কেউ গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হলে তাকে ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার ফলে ইলিশসহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত পাঁচ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী শরণখোলার জেলেদের মাধ্যমে ইলিশ আহরণের হার অনেকটাই বেড়েছে। তবে সাগরের সবখানে ইলিশের সমান প্রাচুর্যতা না থাকায় সব ট্রলারে সমান ইলিশ ধরা পড়ে না। ফলে অনেক মহাজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ’